শ্রীক্ষেত্রের মহিমা


 শঙ্খক্ষেত্রের মধ্যভাগে এক অতি সুন্দর নীল পর্বত শোভমান। ঐ পর্বতে শীর্ষদেশে ভগবান বিরাজ করছেন। শ্রীক্ষেত্র বা পুরীধামকে নীলাচল ধামও বল হয়। নীল অর্থ নীল বর্ণ এবং অচল অর্থ একস্থানে স্থিত পর্বত। বৈষ্ণব তন্ত্রসমূহ নিম্নোক্ত রূপে পুরী ধামের মহিমা কীর্তিত হয়েছে;

মথুরা দ্বারকা লীলাঃ যঃ করোতি চ গোকুলে। নীলাচলস্থিতঃ কৃষ্ণস্তা এব চরতি প্রভুঃ।  “ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গোকুল, মথুরা ও দ্বারকায় যে সমস্ত লীলা করেন, সেই সমস্ত লীলাই তিনি নীলাচল ধামে প্রকট করেন।”

শ্রীচৈতন্যভাগবত গ্রন্থে নিম্নোক্তরূপে পুরী ধামের মহিমা বর্ণিত হয়েছে:

শ্রীকৃষ্ণ স্মিত হেসে বললেন, “হে শিব! শ্রবণ করুন। আমি আপনাকে একটি অত্যস্ত রমনীয় স্থান প্রদান করছি। এখানে আপনি আপনার পার্ষদবর্গ অনুগামীদেরকে নিয়ে বাস করতে থাকুন। এই স্থানটি একাম্রকানন নামে বিদিত ৷ এই স্নিগ্ধ, সুখময়, রম্য কাননে আপনি আবির্ভূত ও পূজিত হবেন। এই স্থানটি অত্যস্ত অধ্যাত্মভাবপূর্ণ, কিন্তু খুব কম ব্যক্তি এই সত্য বিদিত আছেন। আজ আমি আপনার কাছে আমার অতি প্রিয় স্থান এই একাম্রকাননের গুপ্ত রহস্য ব্যক্ত করব। “মহাসাগর তটদেশে এক বিপুল পরিধি নিয়ে এক স্থান বিদ্যমান, যা নীলাচল নামে বিদিত। এই স্থানটি পুরুষোত্তম ক্ষেত্র অর্থাৎ পরমপুরুষের আবাসস্থান নামেও বিদিত। এই স্থানের পরিবেশ পরম মনোহর ও শান্ত। এমনকি মহাপ্রলয়ের সময়েও এই স্থান অটুট, অক্ষয় থাকে। আমি সেখানে নিত্যকাল বাস করি এবং প্রতিদিন সেখানে নিবেদিত রাজকীয় খাদ্যদ্রব্য ভোজন করে থাকি।”

“পুরুষোত্তম ক্ষেত্র আশি বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত এবং এই পরিধির মধ্যে নিবাসরত সকল জীব চতুর্ভুজ দেহসম্পন্ন, যা কেবল দেবগণ ও তাঁদের সমগোত্রীয়দের কাছে পরিদৃশ্যমান। দেবগণ এই স্থানকে সকল স্থানের মধ্যে শ্রেষ্ঠ স্থান রূপে এর মহিমা কীর্তন করে থাকেন। এখানে নিদ্রা গেলেও তা গভীর ধ্যান বা সমাদির সমকক্ষ। ঠিক তেমনি এখানে শয়ন করে থাকলেও তা শ্রীবিগ্রহকে প্রণিপাত করার সমান ফল হয়। এখানে হেঁটে বেড়ালেও পরিক্রমার সমান ফল হয়, আর এখানে সকল কথা পরমপুরুষের মহিমা কীর্তনের সমতুল্য। এই স্থানের এই সব মহিমা বেদে ঘোষিত হয়েছে। এই স্থানটি আমার অত্যন্ত প্রিয়; সেজন্য এই স্থানটি আমার স্বনামে নামাঙ্কিত। এই স্থান মৃত্যুদাতা যমরাজের শাসনের বহির্ভূত। আমি এখানে জীবের পাপ ও পূণ্যকর্মের বিচার কর্তা ও ফলদাতা।                                                                                                                   -শ্রীচৈতন্য ভাগবত ২য়, গদ্যরূপ

বৃহত্তাগবতামৃত (২/১/১৫৯-১৬৩) গ্রন্থে সনাতন গোস্বামী এভাবে পুরী ধামের বর্ণনা করেছেন :

“নীলাচলে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে লবণ মহাসাগরের তীরে ভগবান শ্রীজগন্নাথ অপূর্ব সুন্দর চিন্ময় দারু বিগ্রহ রূপে প্রকটিত। ঐশ্বর্যশালী পরম শক্তিকান্ত ভগবান ব্যক্তিগতভাবে ওড়িষ্যা রাজ্য রক্ষা করছেন। সৌভাগ্যের অধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মীদেবী স্বয়ং তাঁর জন্য রন্ধন করেন। তাঁর ভোজন সমাপন হলে কৃপাময় প্রভু তাঁর ভক্তগণদের তাঁর ভুক্তাবশেষ প্রদান করেন, যা এমনকি দেবতাদেরও দুর্লভ। সেখানকার একটি গাধাও বৈকুণ্ঠ-লোকের অধিবাসী চতুর্ভুজ স্বরূপ। কেউ যদি সেখানে একবার যায় তাহলে তাঁর আর পুনর্জন্ম হয় না ।"

ব্রহ্মপুরাণ এভাবে পুরী ধামের মহিমা বর্ণনা করা হয়েছে :

“ভগবান শ্রীবিষ্ণু যেমন সকলের ঈশ্বর, সর্বলোকমহেশ্বর, পুরুষোত্তম ক্ষেত্র তেমনি সর্বক্ষেত্রের মধ্যে বরিষ্ঠ। ব্রাহ্মণ বর্ণ যেমন সকল বর্ণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং বিনতাপুত্র গরুড় যেমন সকল পক্ষীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, তেমনি পুরুষোত্তম ক্ষেত্র সকল তীর্থগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। মুনিগণের মধ্যে যেমন ব্যাস শ্রেষ্ঠ, যক্ষ রাক্ষসগণের মধ্য যেমন কুবের শ্রেষ্ঠ, তেমনি সমস্ত তীর্থের মধ্যে পুরুষোত্তম ক্ষেত্র শ্রেষ্ঠ । হে মুনিশ্রেষ্ঠ! তুমি যেমন বলেছ, সত্য সত্যই এই পৃথিবীতলে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের ন্যায় কোন তীর্থ নেই।”

পুরুষোত্তমাৎ পরং ক্ষেত্রং নাস্ত্যেব পৃথিবীতলে ।

ভুস্বর্গম্ ইতি বিখ্যাতং দেবানাং অপি দুর্লভম্ ॥

“পুরুষোত্তম ক্ষেত্র ‘পরম’ বা অপ্রাকৃত, চিন্ময় ক্ষেত্র। পৃথিবীতলে এই ক্ষেত্রের ন্যায় আর কোন তীর্থ নেই। এই স্থান ভুস্বর্গ হিসেবে বিখ্যাত এবং এই স্থান দেবগণেরও দুর্লভ।”

কপিল সংহিতায় বলা হয়েছে :

সর্বেষাং চৈব দেবানাং রাজা শ্রীপুরুষোত্তমঃ ।

সবের্ষাং চৈব ক্ষেত্রাণাং রাজা শ্রীপুরুষোত্তমঃ ॥

“শ্রীপুরুষোত্তম জগন্নাথদেব সকল দেবগণের রাজা এবং শ্রীপুরুষোত্তম ক্ষেত্র সকল ক্ষেত্র বা ধামেরও রাজা স্বরূপ।”

স্কন্দপুরাণে পুরীধামের মহিমা

স্কন্দপুরাণে শ্রীলক্ষ্মীদেবী যমরাজকে বলছেন, “হে যমরাজ! এই দিব্যক্ষেত্র আপনার কোন প্রভাব নেই। এই স্থান লাভ করা অত্যন্ত দুর্লভ। এই ক্ষেত্র নিবাসরত সমস্ত জীব আপনার নিয়ন্ত্রাধীন নয়। তাঁরা আপনার শাসন-সীমার বাইরে। এখানে যাঁরা মোক্ষকামী, তাঁরা এই ধামে বাসকালে ইতোমধ্যেই মুক্তি লাভ করেছেন। শ্রীবিষ্ণু অন্য সকল স্থানে জীবসত্তাকে জড় বন্ধনগ্রস্ত করে রেখেছেন। কিন্তু শ্রীক্ষেত্রে তিনি সকলকে মোক্ষদান করেছেন। এমনকি প্রলয়কালেও এই স্থান ধ্বংস হয় না।”

বিষ্ণুপুরাণে (চতুর্থ অধ্যায়ে) মহালক্ষ্মী যমরাজকে বলছেন:

পৃথিব্যাং যানি তীর্থানি গগনে চ তৃপিষ্টপে।

সার্দ্ধকোটি সংখ্যানি স্বৰ্গমোক্ষ প্ৰদানি চৈব ॥

তেষাময়ং তীর্থরাজঃ কীর্তিতঃ পুরুষোত্তমঃ ।

সর্বেষাং মুক্তি ক্ষেত্রানামিদং সাযুজ্যদং মতম্ ॥

“হে ধর্মরাজ! এই পৃথিবীতে, গগনে ও স্বর্গে যে মোট সাড়ে তিন কোটি স্বর্গ-মোক্ষ প্রদায়ক তীর্থ বিরাজিত, তাদের মধ্যে পুরুষোত্তম ক্ষেত্র তীর্থরাজ রূপে কীর্তিত। সকল মুক্তিক্ষেত্রের মধ্যে এই ক্ষেত্র সাজুয্য মুক্তি প্রদায়ক।”

ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে এভাবে পুরীধামের মহিমা ঘোষিত হয়েছে:

বর্ষানাং ভারতঃ শ্রেষ্ঠো দেশানাং উৎকলঃ স্মৃতঃ।

উৎকলস্য সমাদেশঃ দেশো নাস্তি মহীতলে ॥

“সকল বর্ষগণের মধ্যে ভারতবর্ষ শ্রেষ্ঠ। সকল দেশের মধ্যে উৎকল দেশ, উড়িষ্যা শ্রেষ্ঠ । উড়িষ্যার সমান এই মহীতলে আর কোন দেশ নেই।”

মাসিক চৈতন্য সন্দেশ, জুন-২০১২ ইং সংখ্যায় প্রকাশিত

No comments

Powered by Blogger.